
রাশিয়ান সাহিত্য শুধু এক দেশের সাহিত্য নয় — এটা রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিশ্বমানের মানবিক অনুভূতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে সংযুক্ত। 19 শতাব্দীর শেষভাগ থেকে 20 শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত রাশিয়ায় এমন এক সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে যা আজও অনুপ্রেরণার উৎস। এখানে পাঁচজন রুশ সাহিত্যিককে নিয়েছি, যারা এই স্বর্ণযুগকে ভরিয়ে দিয়েছেন।
১. আলেকজান্ডার পুশকিন
- জন্ম ও মৃতু্যঃ ১৭৯৯–১৮৩৭।
- সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হলেও পুশকিন ছিলেন বিপ্লবী চিন্তার অধিকারী। স্বল্পবয়সে ফরাসি ভাষায় কথা বলা ও পড়া শুরু করেছিলেন, কিন্তু ১৫ বছর বয়সেই রচনা শুরু করেছিলেন নতুন রূপের কবিতা ও রোম্যান্টিক ধারায়।
- তার লেখা ‘ইয়েভগেনি ওনেজিন’ রাশিয়ান কবিতার একটি মাস্টারপিস, পাশাপাশি ‘বোরিস গোডুনভ’, ‘ত্রুম্স অফ লাভ’ ইত্যাদি কাজও বিশ্বসাহিত্যে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
- ব্যক্তিগত জীবনে পুশকিন ছিলেন চরম সংবেদনশীল, অনাবেগী মনোভাব ও বিতর্কে জড়িত। ডুয়েলের ঘটনাসহ, আর্থিক ও রাজনৈতিক উভয় দিকেই চ্যালেঞ্জ পোহাতে হয়েছে তাকে — কিন্তু সবাই তাকে রাশীয় সাহিত্যলয়ে এক অবিস্মরণীয় কণ্ঠ বলেই স্মরণ করে।
২. নিকোলাই গোগোল
- জন্ম ও মৃতু্যঃ ১৮০৯–১৮৫২।
- পুশকিনের কাছ থেকে প্রভাব পেলেও গোগোল তাঁর নিজস্বস্বত্ব ও রুচি গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে বাস্তব ও ব্যঙ্গমিশ্রিত উপস্থাপন ছিল। তার ছোটগল্প এবং উপন্যাসে রাশিয়ার সমাজ, চাকরিজীবন ও মানুষের সাধারণ দূঃখ-সুখের বৃত্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- বিখ্যাত উপন্যাস “Myortvye Dushi” (Dead Souls) — রাশিয়ার সমাজ ও নৈতিকতার একটি তীক্ষ্ণ প্রতিবিম্ব। এছাড়া ‘দ্য ওভারকোট’ ও অন্যান্য রচনায় গোগোলের হাস্য-ব্যঙ্গ ও বাস্তবতার সমন্বয় অনেকটাই অনন্য।
- জীবনের শেষ দিকে তাঁর সাহিত্য ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসে বড় পরিবর্তন আসে, অন্তরে দ্বন্দ্বে ভুগেছিলেন; উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড ধ্বংস ও মানসিক অবসাদ এসব বিষয় প্রকাশ করে তার ব্যক্তির গভীরতা ও মানবিক দুর্বলতাকে।
৩. ফিওদর দস্তয়োভস্কি
- জন্ম ও মৃতু্যঃ ১৮২১–১৮৮১।
- রাজনৈতিক কারণে নির্বাসন, কঠোর জীবনে থাকা ও মানব মনের অন্ধকার কোণগুলো বিশ্লেষণ করাই ছিল তার রচনা-শৈলী।
- তার প্রধান উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ইডিয়ট’, ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’, ‘দ্য ডেমনস’ রয়ে গিয়েছে বিশ্বসাহিত্যে মাইলফলক হিসেবে। চরিত্রগুলোর নৈতিক দ্বন্দ্ব ও মানসিক চাপ- এসবই দস্তয়োভস্কির লেখায় জীবন্ত হয়ে ওঠে।
- দস্তয়োভস্কি শুধু একজন লেখক নন, ছিলেন দর্শন, মনস্তত্ত্ব ও ধর্মচিন্তারও গুরুর মতো। তার ব্যক্তিগত জীবনও যখন অনেক কাহিনী তৈরি করে — রোগ, আর্থিক সংকট, যোগ্যতার স্বীকারোক্তি — তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গাকে আরও গভীর করে তোলে।
৪. লিও তলস্তয়
- জন্ম ও মৃতু্যঃ ১৮২৮–১৯১০।
- ‘ওয়ার এন্ড পিস’ ও ‘আন্না কারেনিনা’ — দুইটি উপন্যাসই রাশিয়ার বৃহত্তর সমাজ, যুদ্ধ ও ব্যক্তিগত আবেগের একটি মূর্ত প্রতীক। প্রথমটি ইতিহাস ও পলিটিক্সের সাথে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত গল্পের একটি মহাকাব্য, দ্বিতীয়টি প্রেম, নৈতিকতা ও সামাজিক নিয়মের মধ্যে গড়ানো এক মানুষের সংঘর্ষের চিত্র।
- তলস্তয় শুধু উপন্যাসই নয়, ছোটগল্প, আত্মজীবনী ও ধর্মচিন্তার রচনাও করেছেন। তাঁর দর্শন, অহিংসতা ও মানবতার প্রতি বিশ্বাস—এই সব বিষয়গুলি মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিদেরকেও অনুপ্রাণিত করেছে।
- জীবনের শেষের দিকে তাঁর মনোভাব ও জীবনযাপন আরও আধ্যাত্মিক হয়েছিল; শান্তি ও নৈতিক শান্তির সন্ধানে ছিলেন তিনি, যদিও তার প্রায়শই সামাজিক এবং পারিবারিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি।
৫. আন্তন চেখভ
- জন্ম ও মৃতু্যঃ ১৮৬০–১৯০৪।
- ডাক্তার হিসেবে কাজ করলেও সাহিত্য ছিল তাঁর অভ্যাস ও প্রতিভার জায়গা; মানুষের সাধারণ জীবনের ব্যথা ও সুখ তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে।
- তার নাটক যেমন ‘থ্রি সিস্টার্স’, ‘দ্য সিগল’, ‘দ্য চেরি অরচার্ড’ বিশ্বব্যাপী পরিচিত; আর ছোটগল্পগুলো—‘দ্য লেডি উইথ দ্য ডগ’, ‘দ্য স্টেপ’, ‘এ ড্রিম স্টেপ’ ইত্যাদি—মানুষ এবং প্রকৃতির সংহতি, পারিবারিক ও সমাজের অন্তরালের অনুভূতি তুলে ধরে।
- জীবনের শেষ দিকে যক্ষ্মায় মৃতু্য এবং চিকিৎসা ও আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে ছিলেন; তারপরও সাহিত্যিক মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন।
রাশিয়ান স্বর্ণযুগের শিক্ষণীয় বিষয়
- মানব মনের গভীরতা — এই পাঁচ লেখকের কাজেই দেখা যায় মানুষের আবেগ, দ্বন্দ্ব, সিদ্ধান্ত ও অপরাধ—সবকিছুই খুব নিকট থেকে বিশ্লেষিত হয়েছে।
- সামাজ ও রাজনীতি — সাহিত্যে শুধু ব্যক্তিগত গল্প নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোরও অবিচ্ছেদ্য অংশ রয়েছে।
- ভাষা ও রূপের দৃষ্টিকোণ — রোম্যান্টিক কবিতা হোক বা সামাজিক উপন্যাস, রুশ সাহিত্য রূপের ক্ষেত্রে পারদর্শী, নাট্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে উপাদেয়।
- অনুপ্রেরণা আজও টিকে আছে — ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ এখনো হচ্ছে, এবং বিশ্বসাহিত্যে এই সাহিত্যিকদের কাজ নতুন প্রজন্মকে সাহস ও চিন্তার নতুন মাত্রা দেয়।
রাশিয়ার স্বর্ণযুগ শুধু একটি সাহিত্য-কলার এক অধ্যায় নয়, এটা মানবতার একটি স্মারক, যা সময় ও সংস্কৃতি পার হলে এবং যুগ বদলালে তার গুরুত্ব কমে যায় না। এই পাঁচ সাহিত্যিক—পুশকিন, গোগোল, দস্তয়োভস্কি, তলস্তয় এবং চেখভ—আজও আমাদের পড়তে ও ভাবতে বাধ্য করে।